ফজরের আযানের পর বিছানায় শুতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এলো । কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বলতে পারবো না । হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভাঙল । চোখ খুলে বুঝতে পারলাম না শব্দটা কোথা থেকে আসছে । দ্বিতীয় বার শব্দ হতেই বুঝলাম প্রচণ্ড জোড়ে কেউ দরজায় আঘাত করছে ।


ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি পৌনে ছয়’টা বাজে । এক ঘণ্টাও ঘুমাতে পারিনি । এলোমেলো পা ফেলে দরজা খুলতেই দেখি পুলিশের সেই এসআই দাঁড়িয়ে আছে । পুলিশ দেখে আমি চমকে উঠলাম । কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,কি ব্যাপার ?

ভাল করে তাকাতে পারছিনা । মনে হচ্ছে চোখের ভেতর অসংখ্য সূচ ফুটছে । দু হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে এসআইয়ের দিকে তাকালাম ।

আপনিই তো রঞ্জু সাহেব ?

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, জি .....

দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করতে হলো । একটু নীচে আসুন।

কেন কি হয়েছে ?

আসুন না, গেলেই তো দেখতে পাবেন ।

কোথায় যেন পড়েছিলাম রিকশা চালক আর পুলিশের সঙ্গে কখনো তর্ক করতে নেই তাতে সম্মানহানির আশঙ্কা থাকে । সেই বাক্যটা মনে করে আলনা থেকে একটা সার্ট টেনে গায়ে দিয়ে এসআইয়ের পিছু পিছু বারান্দা ধরে হাটতে শুরু করলাম । সিঁড়ির নিচে ছোট খাটো একটা জটলা চোখে পরলো। কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে । ভিড়ের মধ্যে অন্য সবার সাথে এফডিসির সামনে দেখা সেই পাগল লোকটাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমি চমকে উঠলাম । কালো কোট, হলুদ চোখ, বিশাল মাথাওয়ালা লোকটাকে চিনতে কোন অসুবিধা হলো না । হাসি হাসি মুখ করে লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠল । মাথা ঘুরে পরে যেতে গিয়ে সিঁড়ির রেলিংটা থাবা দিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম ।

ব্যাপারটা খেয়াল করে, অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে এসআই জিজ্ঞাসা করলেন, কি হলো ?

কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারলাম না । নিজেকে কোন রকম সামলে নিয়ে আবারও তাকালাম জটলাটার দিকে কিন্তু সেই লোকটাকে আর দেখতে পেলাম না । মনে মনে বললাম, আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি ।

দু'টো সিঁড়ি নামতেই দেখতে পেলাম, সিঁড়ির পাশের মেঝেতে কেউ একজন উপুড় হয়ে পরে আছে । ঘাড়টা বিশ্রী ভাবে ডানপাশে মোচড়ানো । রক্তের দু’টো ধারা গড়িয়ে মেঝেতে নেমে গেছে ।

উপর থেকে এক নজর দেখেই বুঝলাম বেঁচে নেই কিন্তু কে ওভাবে পরে আছে চিনতে পারলাম না । পেছনটা দেখে বদরুল বলে মনে হলো । দ্রুত পা ফেলে নীচের নেমে গেলাম । কাছে গিয়ে বদরুলকে চিনতে মোটেই বেগ পেতে হলো না । বদরুলকে এভাবে অপঘাতে মরতে দেখে আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। পরপর দু’টো মৃত্যু আমাকে হতবিহম্বল করে দিলো । মাথাটা ঘুরে উঠলো । নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে উহু শব্দটা বের হয়ে এলো ।


এসআই আমাকে ধরে কাউন্টারের সামনে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন । আমি এসআইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কিভাবে ?

সেটাই তো জানতে চেষ্টা করছি । ভোরে কেউ একজন থানায় ফোন করে খুনের ঘটনাটা জানায় । তবে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, পেছন থেকে কেউ খুব জোড়ে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ির উপর থেকে ফেলে দিয়েছে ।

কথাটা বলে একটু থেমে কিছু একটা চিন্তা করে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি তো দোতালাতেই থাকেন।”

আমি মাথা নাড়ালাম , হা ।

আচ্ছা, বদরুল সাহেবের সঙ্গে আপনার কখন শেষ দেখা হয়েছে ?

গতকাল রাতে ।

রাত ! কখন ?

১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে । আমি এসআইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম ।

কি নিয়ে কথা হয়েছে ?

বদরুলের কাছ থেকে কয়েকটা বিষয় জানতে চেয়েছিলাম ।

কি জানতে চেয়েছিলেন?

আমার গতরাতে দেখা স'দুভাই এর মুখটা মনে পরে গেল । আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, পারেন ।

তা হলে বলে ফেলুন । দয়া করে লুকাবেন না বা মিথ্যা কিছু বলবেন না ।

মেসের অনেকে নাকি স'দু ভাইকে মেসের মধ্যে ঘুরে বড়াতে দেখেছে । আমার কাছে মনে হয়েছিলো পুরো ব্যাপারটা বানোয়াট । তাই বদরুল'কে ডেকে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম আসলে ঘটনাটা কি ?

উনি কি বললেন ?

বদরুল আমাকে জানালো বিষয়টা সত্য । সে ও নিজেও নাকি পরপর দুবার স'দু ভাইকে দেখেছে ।

কবে দেখেছে, কোথায় দেখেছে ? এসআই বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন । দেখে বুঝা গেলো স'দু ভাইকে দেখার বিষয়টা উনি বিশ্বাস করনি ।

স'দু ভাইয়ের মৃত্যুর দু’দিন পরে, স'দু ভাইয়ের রুমে দেখেছে ।

এসব মিথ্যে কথা । যতোসব গাল,গপ্প । একজন মৃত মানুষ কখনো দেখা দেয় না ।

আমিও প্রথমে তাই ই মনে করেছিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই সত্যটা হচ্ছে ............।


এই পর্যন্ত বলে গতরাতে নিজ চোখে দেখা ঘটনাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম । অহেতুক বিপদ ঢেকে আনার কোন মানে হয় না ।


এসআই বুদ্ধিমান মানুষ আমাকে থেমে যেতে দেখে একটু হেসে বললেন,"আসল সত্যিটা" বলতে কি আপনি স'দু সাহেবকে দেখার বিষয়টা বলতে চাচ্ছেন ?


আমি মাথা নেড়ে বললাম, জি হ্যাঁ ।

আপনার মতো একজন শিক্ষিত মানুষ বলছেন এ কথা ?

একটু ভেবে নিয়ে , এসআই এর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, বলছি, কেননা গতরাতে আমিও স'দু ভাইকে দেখেছি । তারপর এসআইকে গতরাতের পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম । সব শুনে এসআই বললেন, স্ট্রেঞ্জ ! এতো দেখছি সত্যিই ভৌতিক ব্যাপার । আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম ।


পরপর দু’টো মৃত্যু ঘটনায় পুরো শহরে হৈ চৈ পরে গেছে । রাতে মেসের হল রুমে অন্য সব বোর্ডারদের সাথে বসে বিটিভির সংবাদ মধুমিতা মেসে হত্যাকাণ্ডের নিউজ দেখলাম । বোর্ডারা মেস ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে , কিন্তু থানা থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে , কেউ যেন মেস ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না । গেলেই এরেস্ট করা হবে । পুলিশ মেসের সকলের নাম, দাম, ঠিকানা টুকে নিয়ে গিয়েছে । ফলে কেউ চাইলেও মেস ছেড়ে যেতে পারছে না ।


প্রতিদিনই লোকজন মেসটাকে দেখতে আসতে শুরু করেছে । কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় লাল কালিতে বড় বড় করে ছবিসহ হেডলাইন ছাপা হলো, “মেস মালিকের আত্মহত্যার পর কর্মচারীর রহস্যজনক মৃত্যু । এলাকাবাসী বলছে, ভৌতিক ঘটনা ”। পত্রিকা বিক্রির এর চেয়ে বড় বিজ্ঞাপন আর কি হতে পারে ।


একটা দৈনিকে পুলিশ কে খোঁচা দিয়ে ছাপাল, “পুলিশের নাকের ডগায় ঘটে চলেছ একের পর এক হত্যাকাণ্ড, পুলিশ রহস্যের কূল কিনারা করতে পারছে না । মেস ও আশেপাশের লোকজন বলছে, ভূতুরে কাণ্ড।”


অদ্ভুত একটা বিষয় খেয়াল করছি দু'দিন ধরে, মধুমতি মেসের উঠানের ঠিক মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড একটা আম গাছ রয়েছে। গাছটা নাকি স'দু ভাইয়ের পর দাদা লাগিয়েছিলেন । গাছের গোঁড়াটা লাল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। সকল বিকেল নানা রকমের পাখির কলকাকলিতে গাছটা মুখর হয়ে থাকতো , কিন্তু স'দু ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে গাছে আর কোন পাখি বসছে না । এ কথাটাও চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছে । কেউ কেউ বলছে, এই গাছেই নাকি ভূত আছে । তাই গাছটিকে কেটে ফেলতে হবে ।


দু’জন পুলিশ পালা করে মেসে সেখানে বসতে শুরু করেছে । আমি মনে মনে ঠিক করে ফেললাম মেস ছেড়ে দেবো । এ'তে সামস্ সাহেবের সঙ্গে এর মধ্যে দু’দিন ফোনে কথা হয়েছে । তিনি স্বাভাবিক খোজ খবর নিয়ে আরেক জন পরিচালকের খোঁজ দিয়ে বলেছেন, তিনি নাকি একটা ভাল চিত্রনাট্য খুঁজছেন । তিনি ঐ পরিচালকে আমার কথা বলে ঠিকানা দিয়ে দিয়েছেন , ভদ্রলোক যে কোন দিন আসবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে ।

নিজের ভাগ্যের এ পরিবর্তনে আমি আনন্দিত হবার পরিবর্তে ক্রমশ ভীত হয়ে উঠছি । বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, হলুদ দুটো চোখ আর কুৎসিত একটা মুখের হাসি ।

স'দু ভাইকে দেখার পর থেকে আমার চারপাশে অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটছে । প্রায় রাতেই বারান্দায় কারো পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যেও যেন কারো উপস্থিতি টের পাচ্ছি ।লেখালেখি নিয়েও চলছে তুগলগি কারবার ।

কোন একটি কাহিনী চিন্তা করে লেখা শুরু করলেই প্রচণ্ড ঘুম পেয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই আর চোখ খোলা রাখতে পারি না । লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে পরি । সকালে উঠে নিজেকে হয় বিছানায় নয়তো মেঝেতে আবিষ্কার করি । সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে লেখাটা লিখতে শুরু করে ছিলাম সেটা পুরোপুরি শেষ করা অবস্থায় পাই ।

একরাতে মধ্যে একটা পুরো চিত্রনাট্য তৈরি করা আমার পক্ষে মোটেও সম্ভব নয় । কিন্তু হাতের লেখা হুবহু আমার। আমার লেখাতে এমনিতে খুব কাটা ছেড়া হয় । কিন্তু এ লেখাগুলো একেবারে নিখুঁত । এ রকম অদ্ভুত ঘটনায় আমি বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছি । আর একটি বিষয় আস্হির হয়ে উঠেছি সেটা হচ্ছে, ইদানীং প্রায় ই গভীর রাতে মনে হয় স'দু ভাইয়ের রুম থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। খুবই করুন সে কান্নার শব্দ। মাঝে মাঝে কেউ এসে দরজায় টোকা দেয় । আমি ভয়ে জমে থাকি । কিছুতেই আর দরজা খুলি না ।মনে হচ্ছে, পাগল হয়ে যাচ্ছি ।


প্রচণ্ড রকমের ক্ষুধা মন্দা দেখা দিয়েছে । কিছু খেতে পারছি না । কিছু মুখে দিলেই বমি হয়ে যাচ্ছে । দ্রুত স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে । আয়নার সামনে দাঁড়ালে বুঝতে পারি চোখ মুখ ভেতরে বসে যাচ্ছে । চোখের নিচে কালি জমছে । কোন কিছু ভাল লাগে না । সর্বক্ষণ এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে নিজের মধ্যে । কোন কাজই মন দিয়ে করতে পারছি না। একটার পর একটা সিগারেট টেনে চলি । কোন কোন রাতে দেখা যায় জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পরছি ।


চলবে ......